মাটির সুর, প্রাণের গান: বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাস, বাদ্যযন্ত্র এবং ঘরানা
নদীর স্রোতে ভেসে আসা সুর
ধর্ম ও দর্শনের মিলন: বাংলা ফোক মিউজিকের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এখানে হিন্দু বৈষ্ণব পদাবলি আর সুফিবাদের এক অদ্ভুত মিলন ঘটেছে। একদিকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি নিবেদন—সব মিলেমিশে একাকার। মরমি সাধক: লালন সাঁই, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, আর শাহ আব্দুল করিমের মতো মহাজনরা এই গানকে শুধু বিনোদন নয়, বরং একটি দর্শনে রূপান্তর করেছেন। লালন যখন বলেন, "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি", তখন তিনি আসলে দেহ ও আত্মার সম্পর্কের কথা বলেন। এই 'দেহতত্ত্ব' হলো বাংলা লোকগানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।
বাউল গান (আত্মার খোরাক): বাউল গানকে ইউনেস্কো 'মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কুষ্টিয়া, যশোর এবং বৃহত্তর নদীয়া অঞ্চল হলো বাউল গানের চারণভূমি। বাউলরা ঘরকুনো নন, তারা পথে পথে ঘোরেন। তাদের গানে সংসার ত্যাগ, সৃষ্টিকর্তার সন্ধান এবং মানুষের জয়গান থাকে। একতারা আর ডুগডুগি বাজিয়ে যখন তারা গান ধরেন, তখন মনে হয় জাগতিক সব কষ্ট তুচ্ছ। ভাটিয়ালি (নদীর গান): ভাটিয়ালি হলো মাঝিদের গান। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল অর্থাৎ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং সিলেটের হাওর এলাকার গান এটি। নদীতে যখন পাল তোলা নৌকা ভাসে, মাঝির হাতে তেমন কাজ থাকে না। তখন বিশাল নদীর শূন্যতা আর প্রকৃতির বিশালতার সাথে পাল্লা দিয়ে মাঝি গলা ছেড়ে গান ধরেন। ভাটিয়ালি গানে 'টান' বা দীর্ঘ স্বর থাকে, যা নদীর স্রোতের মতোই প্রলম্বিত। ভাওয়াইয়া (উত্তরের দীর্ঘশ্বাস): রংপুর, দিনাজপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের গান হলো ভাওয়াইয়া। এই অঞ্চলটি কিছুটা উঁচু ও রুক্ষ। এখানকার মানুষ গরুর গাড়ি চালায়। গরুর গাড়ির চাকা যখন এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলে, তখন যাত্রীর গলার স্বর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এই কাঁপা স্বর বা 'ভাজ' হলো ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য। এই গানে প্রেম এবং বিরহ খুব করুণভাবে ফুটে ওঠে। আব্বাসউদ্দীন আহমদ এই গানকে শহরের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিয়েছিলেন। গম্ভীরা (রঙ্গরসে সমাজ সচেতনতা): চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা এক অনন্য লোকনাট্য ও গান। এখানে 'নাতি' এবং 'নানা'র চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতি বা সমস্যা তুলে ধরা হয়। এটি মূলত শিবপূজার অংশ ছিল, যা পরে সামাজিক গানে রূপ নেয়। এর তালে তালে যে নাচ হয়, তা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। জারি ও সারি গান: জারি গান সাধারণত শোকের গান, যা মহরমের সময় গাওয়া হয়। আর সারি গান হলো কর্মসংগীত। বিশেষ করে নৌকা বাইচের সময় মাঝিদের উৎসাহ দিতে সারি গান গাওয়া হয়। "হেইয়্যারে হেইয়্যা" ধ্বনির সাথে যে রিদম তৈরি হয়, তা শরীরে অদ্ভুত এক শক্তি যোগায়।
একতারা: বাউল গানের প্রতীক। লাউয়ের খোলের সাথে একটিমাত্র তার। এই একটি তারেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুর তোলা হয়। এটি মূলত তাল বা ড্রোন ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দোতারা: লোকগানের মূল মেলোডি বা সুর তোলে দোতারা। নাম দোতারা হলেও এতে চারটি বা তার বেশি তার থাকে। কাঁঠাল বা নিম কাঠ দিয়ে তৈরি এই যন্ত্রের টুংটাং শব্দ মনকে এক নিমেষে গ্রামে নিয়ে যায়। বাঁশি: বাঁশের বাঁশি ছাড়া বাংলা গান অসম্পূর্ণ। ভাটিয়ালি গানে বাঁশিতে যে করুণ সুর তোলা হয়, তা শুনলে মনে হয় বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। ঢোল ও খোল: গানের রিদম বা তাল ধরে রাখার জন্য ঢোল অপরিহার্য। বিশেষ করে জারি, সারি বা কবিগানে ঢোলের গুরুগম্ভীর শব্দ রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আর কীর্তন বা বৈষ্ণব গানে ব্যবহৃত হয় খোল বা মৃদঙ্গ। মন্দিরা: ছোট দুটি কাঁসার বাটি। একে অপরের সাথে ঠুকে যে ঝনঝন শব্দ হয়, তা গানের লয় ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *




.webp)
 (1080 x 1080 px).webp)
.webp)
.webp)
.webp)